
তারিখ অনুযায়ী মাসিক না হওয়ার কারণ: বিশদ ব্যাখ্যা ও সতর্কতা
মাসিক বা ঋতুস্রাব নারীর প্রজনন ব্যবস্থার একটি স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। সাধারণত প্রতি ২৮ থেকে ৩৫ দিন অন্তর একজন সুস্থ নারীর মাসিক হওয়া উচিত। কিন্তু অনেক সময় নির্ধারিত তারিখে মাসিক না হলে মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটে, উদ্বেগ বেড়ে যায় এবং গর্ভধারণ নিয়ে চিন্তা দেখা দেয়।
এই ব্লগে আমরা জানবো, তারিখ অনুযায়ী মাসিক না হওয়ার পেছনে বিজ্ঞানসম্মত কারণসমূহ, প্রতিকার ও কখন ডাক্তার দেখানো উচিত।
গর্ভধারণ (Pregnancy)
সবচেয়ে প্রচলিত কারণ হলো গর্ভধারণ। যদি মাসিক নির্দিষ্ট সময়ে না আসে এবং আপনি যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হয়ে থাকেন, তাহলে প্রেগনেন্সির সম্ভাবনা থাকেই।
করণীয়:
-
প্রথমে ঘরে বসেই প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট ব্যবহার করুন।
-
যদি ফলাফল নেগেটিভ আসে এবং মাসিক না হয়, তাহলে কয়েক দিন পরে পুনরায় পরীক্ষা করুন।
হরমোনজনিত ভারসাম্যহীনতা (Hormonal Imbalance)
নারীর মাসিক নিয়ন্ত্রণ করে দুটি প্রধান হরমোন – ইস্ট্রোজেন (Estrogen) এবং প্রোজেস্টেরন (Progesterone)। এই হরমোনগুলোর মাত্রা কমে গেলে বা হঠাৎ বেড়ে গেলে মাসিকের তারিখ পরিবর্তিত হতে পারে।
সম্ভাব্য কারণ:
-
থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা
-
পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOS)
-
অতিরিক্ত ইনসুলিন বা হরমোন সংশ্লিষ্ট রোগ
মানসিক চাপ ও উদ্বেগ
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত মানসিক চাপ শরীরের কর্টিসল হরমোনের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। এটি সরাসরি প্রভাব ফেলে মাসিক চক্রে। ফলে মাসিক দেরিতে আসে বা বন্ধও হয়ে যেতে পারে।
সমাধান:
-
প্রতিদিন কিছু সময় মেডিটেশন বা যোগাসন করুন
-
পর্যাপ্ত ঘুম নিন
-
সময়মতো পুষ্টিকর খাবার খান
অতিরিক্ত ওজন বা হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া
শরীরের ওজন হঠাৎ বেড়ে গেলে বা দ্রুত কমে গেলে শরীরের হরমোনে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। এই কারণে মাসিক অনিয়মিত বা বন্ধ হতে পারে।
বিশেষ করে শরীরের অতিরিক্ত চর্বি এস্ট্রোজেন উৎপাদনে প্রভাব ফেলে, যা মাসিক চক্রে বাধা সৃষ্টি করে।
অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম
যেসব নারী প্রতিনিয়ত ভারী ব্যায়াম করেন বা পেশাদার খেলোয়াড়, তাদের মধ্যে মাসিক দেরি হওয়ার প্রবণতা বেশি। শরীরে চর্বির পরিমাণ কমে যাওয়া, অতিরিক্ত শক্তি ক্ষয় বা হরমোনের নিঃসরণ কমে যাওয়াও এর কারণ হতে পারে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ও অন্যান্য ওষুধের প্রভাব
অনেক নারী জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি (Oral contraceptives) খাওয়ার পর মাসিক নিয়মিত হতে পারে, আবার কেউ কেউ মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যাও পান। এছাড়াও, এন্টিডিপ্রেসেন্ট, স্টেরয়েড, থাইরয়েডের ওষুধ ইত্যাদি মাসিক চক্রে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
রোগ বা স্বাস্থ্যগত জটিলতা
কিছু দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন:
-
ইউটেরাস বা ওভারি সংক্রান্ত রোগ
-
থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা
-
হাইপারপ্রোল্যাকটিনেমিয়া
-
লিভার বা কিডনি জটিলতা
→ এসব কারণে মাসিক সময়মতো না-ও হতে পারে।
বয়স সংক্রান্ত হরমোন পরিবর্তন
বয়ঃসন্ধিকালে (Puberty) বা মেনোপজের (Menopause) দিকে নারীদের হরমোন স্বাভাবিকভাবেই ওঠানামা করে, যার ফলে মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায় বা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শেই নিশ্চিত হওয়া উচিত।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি?
-
টানা দুই বা তিন মাস মাসিক না হলে
-
অতিরিক্ত ব্যথা, ভারী রক্তপাত বা অস্বাভাবিক স্রাব হলে
-
মাসিক অনিয়মিত থাকলেও গর্ভধারণের সম্ভাবনা না থাকলে
-
হঠাৎ অতিরিক্ত ওজন কমে গেলে
→ এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে গাইনোকলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ঘরোয়া কিছু করণীয়
-
প্রতিদিন হালকা গরম পানি পান করুন
-
আদা, পুদিনা বা দারুচিনি চা খাওয়া যেতে পারে
-
পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন
-
পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখুন
গর্ভধারণ থাকলে ঘরোয়া উপায় প্রয়োগ না করাই ভালো।
সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQs)
১. মাসিক নির্দিষ্ট তারিখে না হলে গর্ভধারণ হয়েছে কি?
→ এটি সম্ভব, তবে একমাত্র কারণ নয়। গর্ভধারণ পরীক্ষা করতে হবে।
২. মাসিক এক সপ্তাহ দেরি হলে কি চিন্তার কারণ?
→ অনেক সময় আবহাওয়া, মানসিক চাপ বা ওজনের কারণে দেরি হতে পারে। এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে দেখতে পারেন।
৩. কীভাবে বুঝবো হরমোনের কারণে মাসিক বন্ধ হয়েছে?
→ শরীরে অতিরিক্ত চুল, মুখে ব্রণ, অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়া – এগুলো লক্ষণ হতে পারে। রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায়।
৪. প্রেগনেন্সি না থাকলেও মাসিক না হলে কী করবো?
→ একজন গাইনোকলজিস্টের সঙ্গে দেখা করে রক্ত ও হরমোন পরীক্ষা করাতে হবে।
উপসংহার
তারিখ অনুযায়ী মাসিক না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। সবসময় গর্ভধারণই একমাত্র ব্যাখ্যা নয়। তাই উদ্বিগ্ন না হয়ে নিজের শরীর, খাদ্যাভ্যাস ও মানসিক অবস্থার যত্ন নেওয়া উচিত। যদি মাসিক অনিয়ম নিয়মিত হতে থাকে, তবে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত।